রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো সহিংসতার বর্ণনা দিতেই সংবাদ মাধ্যমগুলোতে বারবার ব্যবহার করা হয়েছে জাতিগত নির্মূল শব্দটি। আর সেই ঘটনার সাক্ষী যারা সেই সাহসী চার রোহিঙ্গা নারী জানিয়েছেন তাদের দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা। বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর শুনিয়েছেন মিয়ানমার নামের ‘নরকের’ গল্প।
২২ বছর বয়সী রশিদা বেগম, আগস্টে সেনাবাহিনীর হামলার পর পালিয়ে আসেন বাংলাদেশে। রশিদা বলেন: একদিন তাদের গ্রামে সেনাবাহিনী এসে পেট্রোল বোমা মেরে প্রায় সব ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। সেই গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়িতে ঢুকে অতর্কিত গুলি চালিয়ে ছেলেদের হত্যা করে । আর শিশুদের নদীর পানিতে ফেলে হত্যা করে। সেই হামলায় রশিদার মা-বাবা, ভাইসহ পরিবারের ১৭ জনের মৃত্যু হয়। নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যান রশিদার স্বামী। কিন্তু প্রাণ বাঁচাতে অন্য কয়েকজনের সাথে নদীর ধারে গিয়ে লুকালেও তাদের ধরে আনে মিয়ানমারের সেনারা। এরপর তাদের একটি পুকুরের ধারে নিয়ে হাঁটু গেড়ে সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে রাখা হয়। আর মাথার ওপর দিয়ে টহল দিতে থাকে সেনাদের হেলিকপ্টার।
এরপর তাদের একটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তার মাত্র ২৫ দিন বয়সী শিশুকে পায়ের নিচে পিষে মেরে ফেলা হয়। তারপর সংঘবদ্ধভাবে রশিদাসহ কয়েক নারীকে ধর্ষণ করে সেই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় বর্বর সেনারা। সেখানে অন্য সবার মৃত্যু হলেও শুধু রশিদাই পালাতে পেরে প্রাণে বেঁচে যান। আট দিন হেঁটে এবং নৌকায় নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে এসে চিকিৎসা নেন রশিদা। সেখানেই তার স্বামীর সাথে দেখা হয় এবং সুস্থ হয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যান।
রশিদার মতোই আরেকজন মমতাজ বেগম। এক রাতে তাদের বাড়িতেও আগুন লাগিয়ে দেয় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। আর মমতাজের স্বামীকে গুলি করে। মৃত্যুর আগে পানি চাইলেও তাকে পানি দেয়নি মিয়ানমার সেনারা। এরপর একদল নারীকে একটি ঘরে নিয়ে শিশুদের সামনেই তাদের ধর্ষণ করা হয়। ওই দৃশ্য দেখে চিৎকার করতে থাকলে শিশুদের রামদা দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলে সেনারা। সেসময় মমতাজ বেগমের ছেলেকে আঘাত করলে তার মাথা দু’ খণ্ড হয়ে যায়। ঘরটিতে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিলে মমতাজ বেগমও দগ্ধ হন, ওই অবস্থাতেই অন্যান্যদের সহায়তায় বাংলাদেশে পালিয়ে বেঁচে যান তিনি।
২৫ বছর বয়সী সানোয়ারা। স্বামী-সন্তান নিয়ে রাখাইনে খুব ভালোভাবেই দিন কাটছিলো তাদের। গাড়ি-বাড়ি, গরুর খামার, জমিজমা সবই ছিলো সানোয়ারার। একদিন তাদের গ্রামেও চলে আসলো মিয়ানমার সেনারা। আগুনে পুড়িয়ে তছনছ করে দিয়েছিলো তার সবকিছু। তার স্বামী আত্মীয়র বাসায় এবং অন্য ছেলে-মেয়েরা সানোয়ারার বাবার বাড়িতে থাকায় সহিংসতা থেকে তারা রক্ষা পায়। কিন্তু তার সাথে থাকা ১৬ বছর বয়সী ছেলেকে পেয়ে তার পেটে গুলি করে ও মাথা কেটে হত্যা করে সেনাবাহিনী। আর হাত-পা বেঁধে নয়জন মিলে ধর্ষণ করে ৮ মাসের অন্তঃস্বত্তা সানোয়ারাকে। শুধু তাই নয় সজোরে পেটে লাথিও মারে মানুষরূপী ওই পশুরা। যখন জ্ঞান ফিরে তখন সানোয়ারা তার ভাই এবং স্বামীকে দেখতে পায়। ওইদিনই তারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার জন্য রওয়ানা হয়। বাংলাদেশে এসেই হাসপাতালে সন্তান প্রসব করে সানোয়ারা। কিন্তু বাচ্চাটিকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।
আগস্টের ২৫ তারিখে তুলাতলী গ্রামে সেনা হামলার পরই বাংলাদেশে পালিয়ে আসে মিনোয়ারা বেগম। ওইদিন সকালে বাড়িতে রান্না করছিলেন মিনোয়ারা। আশপাশে চিৎকারের শব্দ শুনে কী হয়েছে তা দেখতে তার মা গিয়েছিলেন বাড়ির বাইরে। মুহূর্তেই তাদের বাড়িতেই চালানো হয় ভয়াবহ মামলা। সেনাবাহিনীর গুলিতে মৃত্যু হয় ভাই-বোনদের। মিনোয়ারাও গুলিতে আঘাতপ্রাপ্ত হন। মিনোয়ারা জানায়, সে সহ তার আরো কয়েকজন বোনকে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে ধর্ষণ করা হয়। এরপর ওই ঘরে থাকা তিনজন বাদে অন্য সবাইকে হত্যা করে সেখান বোমা মেরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু সৌভাগ্যবশত অন্যদের সহায়তায় বেঁচে যান মিনোয়ারা। এরপরই নিজেদের রক্ষায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেন তারা।
রশিদা, মমতাজ, সানোয়ারা কিংবা মিনোয়ারা, এরকম আরো অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী যারা কাছের মানুষকে হারিয়ে জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশে। এখন আর তারা মিয়ানমার সেনাদের বর্বরতার কথা বলতে ভয় পান না। এমনকি বিশ্বের কাছে নিজেদের নির্যাতনের কথা বলতেও লজ্জা পান না তারা, কারণ সবই সত্য। কিন্তু এ সব কিছুরই বিচার চান রাখাইনের প্রত্যেক রোহিঙ্গা নাগরিক।
পাঠকের মতামত